চলার পথে দেখা


চলার পথে দেখা

॥ রৌদ্র দুপুর ॥
বাউল শাহ্ আব্দুল করিম (প্রচলিত উচ্চারণ শাহ আব্দুল করিম) তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল একবার। জেলা সদর সিলেটে। বর্তমানে এটা বিভাগীয় শহর। আগের চেয়ে শহরটি বহুগুণে  বড়ো হয়েছে। পুরাতন সিলেট আর বর্তমান সিলেটের পার্থক্যও রয়েছে অনেক। যাহোক, আব্দুল করিমের চারন ভূমি এই সিলেটের মাটি ও মানুষের প্রতি আজ আর একবার  শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।- তাঁর কাছে আমি জানতে চেয়ে ছিলাম, তাঁর কাজ সম্পর্কে জেনে তাঁকে ঘৃণা করে অথবা অজ্ঞতাবশত তাঁকে অপছন্দ করে-এমন শত্র“দের মধ্য থেকে কোন ধরনের শত্র“কে তিনি বেশি পছন্দ করেন? তখন তিনি হেসে বলেন, ‘প্রথম শত্র“দলই নাকি তঁর বেশি পছন্দের। কারণ, তারা তাকে মনে করিয়ে দেন যে, তিনি সঠিক পথেই রয়েছেন। ছূরির মতো সুক্ষ্ম নিপুণতায় ফ্যাসিবাদের বাহিনীরা যেরূপভাবে ভয়ঙ্কর কাজগুলোর সৃষ্টি করতো, পাকিস্থানী আমলে আমাদের গান গাওয়া এরূপভাবে কঠিন ছিল।’ আব্দুুল করিম তাঁর বাউল গানের ভেতর দিয়েই ফুটিয়ে তোলেন দেশ এবং সাধারন মানুষ কিভাবে অভিজাতদের দুর্নীতিতে চরমভাবে নিমজ্জিত ছিল। পাক দানবদের বিরুদ্ধে সাহস আর প্রাণের শক্তি দিয়ে প্রবল কন্ঠ নিয়ে জনগণের নানা লড়াইয়ে প্রেরণাযুগিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন। আমৃত্যু দেশী-বিদেশী দানবদের সাথে লড়াই ছিলো তাঁর প্রতি মুহূর্তের জীবন। দেশের অসংখ্য  সাধারন মানুষের জীবনের জন্য ছিলো তাঁর জীবনের লড়াই। মাদুরোর ভাষায় বলি, ‘ জীবনের জন্য যাঁরা মৃত্যুবরণ করেন তাঁদের কখনো মৃত বলা যায় না।’ 
গত ১লা মে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ রোজ বুধবার, ভোর ৪ টা ৩৫ মিনিটে সাংবাদিক মিনহাজ নাসিরের ফোন;- রওয়ানা দে’য়ার তাগদা। জাঁকজমক বিছানার আয়েসকে ত্যাগ করে ওঠতে হলো। আর যখন বাথরুমের কাজ শেষ করে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই,-শাহানাজ ইসলাম তার হাতের ট্রেটি দ্রুত আমার সামনের টেবিলে রেখে গেলেন। এবার আমি ট্রের দিকে নজর দেই। যা আমার খুবই পছন্দ। এক মগ ব্ল্যাক কফি, এক গ্লাস পানি, আর শুকনো দুটো বিস্কুট। কফি শেষ হওয়ার আগেই ফোন আবার বেজে ওঠলো, এবার সাংবাদিক প্রনীত দেবনাথ- এখন রওয়ানা দিতে হয়। আমি যখন হোটেল আল আকবায় পৌঁছি তখন ভোর ৬টা ৫মিনিট। এখানে সবার সাথে দেখা হলো। সবার সাথে ডিম ও রুটি দিয়ে আবার নাস্তা হলো। নাস্তা শেষে লাল চায়ের তৃপ্তিই ছিলো আলাদা। আমরা সাপ্তাহিক কমলগঞ্জ সংবাদ পরিবার। সংবাদের সম্পাদক সানোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে সকাল ৭টা বাজার কিছু পূর্বেই বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সানোয়ার হোসেন যেমন একজন দক্ষ সংগঠক তেমনি রসালো, একজন মজার মানুষ। কমলগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ এসএমসি সভাপতি হিসেবে। দুই দুইবারের নির্বাচিত ব্যাক্তিত্ব। আমরা সকলেই পরস্পর সাথী হয়ে চলছি। এশিয়ান আলিম্পিক থাংথা ফেডারেশনের স্থায়ী সদস্য ও বিশিষ্ট সমাজসেবী হাজী জয়নাল আবেদীন। কমলগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সম্পাদক দৈনিক সমকাল প্রতিনিধি প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ, হাসি-আনন্দে যিনি সর্বদাই শক্তিশালী। সৃষ্টি সংস্কৃতি সংঘের সভাপতি, উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পদক এমরান আহমদ-প্রতি মুহূর্তে যার চেহারায় ফুটে ওঠে যুবকত্বের স্বতঃর্স্ফুত বিপ্লব। উপজেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ আলী-কমলগঞ্জ মডেল স্কুল এন্ড কলেজের গেস্ট টিচার। সফাত আলী সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক আলমগীর হোসেন-যার বাণিজ্য শুধু শিক্ষকতা দিয়ে নয়, নিজস্ব গান দ্বারা-সমাজসেবায়। সকলের প্রিয় ভাজন ফটো সাংবাদিক মিনহাজ নাসির এবং কবি সাইয়িদ ফখরুল। সিলেট থেকে যোগদেন,-সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তা আলী আহমদ।
হাইএস-র ড্রাইভার সিতার মিয়া অত্যন্ত দতার সাথে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। সিলেট থেকে গাড়িটি সুনামগঞ্জের দিকে চলছে। রাস্তার দ’ুপাশের অসংখ্য জারুল এবং কৃষ্ণু চূড়ার গাছ চোখে পড়লো। আর এসব গাছের ফুটন্ত ফুলের সমারোহ জানান দেয় এই  বুঝি বসন্ত এলো। কিন্তু এখন গ্রীষ্মকাল। চারিদিকে কৃষকরা ধান কাটছে। প্রস্ফুটিত সোনালী ধানে পুরো এলাকা এক অপরূপ রূপে সজ্জিত হয়ে ওঠছে। যা সত্যিই মনোমু"কর। আমরা দিরাই বাজার পৌঁছি সকাল ১১ টায়, সেখানে সমকাল প্রতিনিধি টিপু সুলতান, যুগান্তর প্রতিনিধি জিয়াউর রহমান লিটন ও শাহ আব্দুল করিমের ভাগনা শাহ আব্দুল তোয়াহেদের সাথে দেখা হয়। টিপু সুলতান সোনারগাঁও রেস্টুডেন্টে আমাদের ডিম, রুটি ও চা আপ্যায়ন করেন। বেলা সাড়ে ১১ টায় আমরা উজানধল গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সেখান থেকে আমাদের যাত্রা সঙ্গী হন বাউল শাহ্ আব্দুল তোয়াহেদ। দিরাই বাজার থেকে ৮  কিঃমি রাস্তা।  সম্পুর্ণ পাকা।  ভরাম হাওরের ভেতর দিয়ে চলে গেছে উজানধল গ্রামে।  বর্ষাকালে সম্পুর্ণ রাস্তাটি পানির নিচে চলে যায়। একত্রিশ’শ হেক্টর আয়তনের এই ভরাম হাওরে অসংখ্য নারী-পুরুষ কৃষি শ্রমিক আশে পাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরু হাওর জুড়ে বোরোধানের বীজতলা উঠানো থেকে শুরু করে। কাঁদামাটির জমি পরিস্কার পরিুছন্ন করে বোরো ধানের চারা রোপন করে থাকে, আবার ধান কাঁটা থেকে শুরু করে ধান সংরক্ষণের কাজ করে থাকেন। জানাযায়, এই হাওর থেকে প্রতি  বছর কয়েক লাখ টন ধান উৎপাদন করা হয়। যেখানে নারী কৃষি শ্রমিকদের বিরাট অবদান রয়েছে। পুরুষ কৃষি শ্রমিকদের সাথে সমানভাবে কাজ করে তাদের চেয়ে অনেক কম মজুরী পেয়ে থাকেন। কিন্তু কম পেলেও জীবন সংগ্রামের কাছে হার মেনে তারা বছরের পর বছর ধরে এভাবেই এই বিলে কৃষি কাজ করে যাচ্ছেন। সাপ্তাহিক  সংবাদের সম্পাদক সানোয়ার হোসেন বলেন, জাতীয় নারী নীতিমালা ১১ তে নারী কৃষি শ্রমিকদের নায্য মজুরী প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে  সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি বলেন- অবশ্যই নারী কৃষি শ্রমিকদের নায্য মজুরি প্রদানের জন্য স্থানীয় ফসলি জমির মালিকদের এগিয়ে আসা উচিত। ’ 
আমরা দুপুর ১২টার দিকে উজানধল গ্রামে গিয়ে পৌঁছি। শাহ্ আব্দুল করিমের একমাত্র সন্তান  শাহ্ নূর জালাল করিমের সাথে সাাৎ হয় সেখানে। কালনী নদীর তীরের ওপরেই তার বাড়ি। হাজী জয়নাল আবেদীন কালনীর স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ সত্যি এই স্বচ্ছ পানি আর পলি আব্দুল করিমকে বাউল সম্রাটে পরিণত করছি।’ বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম জন্ম: ১৫ ফেব্র“য়ারি ১৯১৬ খ্রি: মৃত্যু ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ খ্রি:। তাঁর স্ত্রী সরলা খাতুন জন্ম ১৯৩৪ খ্রি: মৃত্যু ১৯৯০ খ্রি:। আমরা তাঁদের মাজার শরীফ জিয়ারত করি। ঘরের ভেতর সংরক্ষিত তাঁর ব্যবহৃত আসবাপত্র,-হারমোনিয়াম, একতারা, খোল, ঢোল, করতাল, তবলছি ও টাঙ্গানো ছবিগুলো দেখতে পাই। এসব ঘুরে ঘুরে দেখে এমরান আহমদ বলেন, ‘শাহ্ আব্দুল করিম যেন এক জিন্দালাশ।’ শাহ্ আব্দুল করিম যে ঘরে গানের আসর করতেন, সে ঘরের ভেতরেই তাঁর ভক্তবৃন্দরা আমাদেরে তাঁর রচিত দু’তিনটি গান শুনালো। হাজী জয়নাল আবেদীন গান শুনে নগদ ১ হাজার টাকা তাদের হাতে তুলে দেন। শাহ্ নূর জালাল আমাদেরকে চা-বিস্কুট আপ্যায়ন করেন, বেশ সময় দেন, অত্যান্ত আন্তরিক মানুষ তিনি। 
তখন বেলা সোয়া ২টা, আমরা সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউজে ফিরে আসি। সেখানে আধাঘন্টা বিশ্রামের পর হোটেল রাজধানীতে গিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করি। সেখান থেকে লিটন রায় (ডিসি অফিসের স্টাফ) ও দৈনিক সমকাল পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি পঙ্কজ দে, আমাদেরকে তেঘরিয়া নিয়ে যান। দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর বাড়িতে। আমরা হাসন রাজার বাড়ি, তাঁর আমলের তৈরি গেইট ও মিউজিয়াম দেখলুম। সুরমা নদীর তীর ঘেঁষা  এই বাড়িটির পরিবেশ বেশ মনোমু"কর। মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে তার ব্যবহৃত সকল আসবাবপত্র, খড়ম, হুক্কা, খাসার থাল, পিতলের কলস, পরিধানের আলখাল্লাসহ দর্শনীয় অনেক কিছু। রতি আছে হাছন রাজার স্ত্রীর ব্যবহৃত  চশমা। হাছন রাজা ও তাঁর পরিবারের লোকজনের অনেক ছবি টাঙানো রয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথসহ  অনেক গুণীজনদের  দুর্লভ ছবি সেখানে টাঙানো আছে। যা অবশ্যিই দর্শনীয়। হাসন রাজার উত্তর সূরী দেওয়ান ফিদেল নাহিয়ানের সাথে দেখা হয়। তার মিষ্টি ব্যবহার না ভুলার মতই। সমকাল প্রতিনিধি প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ বলেন, ‘ জমিদার, জোতদারদের আমলে জমি নিয়ে বৈষম্য থাকলেও বাউল কবি, দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর  গানে এরকম বৈষ্যমের কোন চিহ্ন  খুঁজে পাওয়া যায় না। সব শেষে তিনি সাধারন মানুষের মনের রাজা হয়ে ওঠেন, রাজার রাজা হতে চাননি।
আমরা সিলেটের দিকে রওয়ানা হই। তখন সন্ধ্যা। পুরো দিনটি ছিলো মেঘাছন্ন, বাতাসের তীব্রতা ছিল কম। কিন্তু রাত যতই বাড়ছে বাতাসের তীব্রতা ততই বেড়ে চলছে। আমরা যখন বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতিবিদ চৌধুরী হারূন আকবরের বাসায় (আম্বরখানা, সিলেট) পৌঁছি তখন রাত ৯ টার ওপরে বাজে সেখানে চা- নাস্তা করি, তাঁর সমৃদ্ধশালী লাইব্রেরীটি দর্শন করি, তাঁর নিখুঁত ভালবাসায় সিক্ত হই আমরা। কিন্তু বাড়ি ফেরার তাগদা তো কাউকে রেহাই দেয়নি। তাই বিদায়  নিতে হলো।  রাত দশটার ওপরে বাজে তখন। সিতার মিয়া দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছেন। বাতাসের গতিবেগ বেড়েই চলছে। রাজনগর থানায় ঢোকার পর টর্নেটোর মুখোমুখি হয়ে পড়ি একটি সেতুর ওপর গাড়ি থামাতে বাধ্য হলেন সিতার মিয়া। তখন ভারি বৃষ্টি হচ্ছিল। গাড়ির ভেতর ভয়ে জড়সড় আমরা সবাই। কিছুক্ষণ পর টর্নেটো থামলো কিন্তু বাতাসের তীব্রতা পুরোপুরি কাটেনি। হালকা বৃষ্টি ছিলো। এর ভেতর দিয়েই আমরা মৌলভীবাজারের চাঁদনিঘাটের পুল পর্যন্ত এসে পৌঁছি। কিন্তু সেখানে বৈদ্যুতিক খুঁটি বিচ্যুত হয়ে পড়লে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা ইসলামপুর হয়ে ভানুগাছ পৌঁছি তখন রাত পৌনে একটায়। বর্ণনাতীত কষ্টের উল্লেখ এখানে করছি না। একটি দিনও বুঝি যেতে চায় না সমান আনন্দে....bdupur@gmail.com


চলার পথে দেখা

॥ রৌদ্র দুপুর ॥

ছাত্র জীবনের সম্পর্ক,- বলিউড তারকাদের  সম্পর্কের মতো প্রতিনিয়িত জোয়ার-ভাটা চলে। এমন কতজন আছেন, যাদের মনে আছে প্রাথমিক স্কুলের সহপাঠীদের নাম। নিরঞ্জন মালাকার ব্যাতীত অন্যকোন নাম আমার মনে নেই। যার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠছিলো সেই প্রথম শ্রেণীতেই পড়াশোনার সময়। এ নামটিও আবার বিশেষ কারনে মনে আছে। এখানে এর ব্যাখ্যা দেব না। মাধ্যমিক স্কুলের বন্ধুদের মধ্য যারা চিরতরে চলে গেছে,  এমন কয়েকজনের নাম জানা আছে, রামপাশার আব্দুল আহাদ আনছারী, দেখা হলেই বলতো তুই কেমন আছিস...? তার মুখের নজর কাড়া হাসিটি এখনও আমার চোখের আড়াল হয়নি। সে অনেক কথা, অনেক ব্যাথা। মোঃ ইসমাইল হোসেন তার বাড়িটির কথা সঠিক বলতে পারবো না, কোথায় ছিল? ইসমাইলের মতো সৎ এবং সঞ্চয়ী লোক পৃথিবীতে বেঁচে থাকার বড় প্রয়োজন ছিল। আরেকজনের নাম মনে নেই।  সে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ছিল, মেট্রিক পরীক্ষার প্রথম দিনেই চলে গেলো সে। তার সাথে আমাদের কারোরই শেষ দেখা হয়নি। যে ফুলগুলো চলে গেলো গন্ধ ছড়ানোর আগেই। পৃথিবীতে প্রতিটি জীবই মৃত্যুদন্ডে সাজাপ্রাপ্ত আসামী; আর আমরা প্রত্যেকেই এই অদ্ভুদ নিয়মটাকে মেনেই বেঁচে আছি। বাল্লারপার গ্রামে মোঃ কামাল হোসেন আজাদ, বারামপুরের আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরী ওরফে সোরহাব মিয়া, রামেশ্বরপুরের মোঃ ইকবাল হোসেন, সে বর্তমানে মাস্টার। একসময় আমরা কতই না কাছাকাছি ছিলাম। বাল্লারপারে আমার বাল্যকালের অনেকটা সময় কেটেছে। ইকবাল এবং ওয়াহিদের সাথে শিকারে যেতে হতো। ঐ বয়সের স্মৃতিটাতো একেবারে জ্বলজ্বল করে। খুব অল্প বয়স থেকেই আমি ঘরকুনো ছিলাম না। বই পড়ার নেশাই বেশি ছিল। তবে খেলাধুলা করতাম, সাঁতার কাটতাম, উৎসব-টুৎসব গুলোতেও যোগ দিতাম। মাথার লম্বা চুলগুলো চিরুন দিয়ে আঁচড়ানো হতো না, নিয়মিত দাঁড়ি কামানো হতো না, দিনের অনেকটা সময় খালি পায়ে হাঁটতাম  এবং পুরনো জুতা ও জামা-কাপড় পরতে ভালবাসতাম; যা কিনা অনেকটা মার্কিন বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো ছিলো। যাক ওসব কথা।

দুই সতীনের দীঘিটি মাটিয়া মসিজদের পাশাপাশি দেিক্ষণ অবস্থিত। গ্রামঃ দক্ষিণ তিলকপুর, ইউনিয়ন আদমপুর। দীঘিটির চারিপাড়ের উপর কবরস্থান। উত্তর পূর্ব পাড়ে রমিজ উদ্দিনের দাদা মৌলভী আমির উদ্দিনের কবর। নিজাম উদ্দিন মেম্বারের ছেলে রমিজ উদ্দিন। মৌলভী আমির উদ্দিন ছিলেন একজন প্রখ্যাত দরবেশ। স্থানীয় লোকজন এখনো অন্ধকার রাতে তাঁর কবরস্থানে এসে পানি ভর্তি বাঁশের চুঙ্গা রেখে যায়। এ সময় কারো সাথে দেখা করা কিংবা কথা বলা যাবে না। ঠিক এভাবেই আবার ভোরের অন্ধকারেই চুঙ্গাটি নিয়ে আসতে হবে। এক নিয়তে। মাতাল ট্যাক্সিওয়ালা থেকে জটিল রোগে দিকভ্রম শত শত লোক তাতে উপকৃত হচ্ছেন। এ পানি মেয়েদের বিয়ে শাদীতেও বিশেষ ফলপ্রদ বলে জানা যায়। রমিজ উদ্দিন আমাদেরে জানান দেন, চুঙ্গায় যদি সাতপারির দীঘির পানি রাখা যায় তাহলে সাত দিনের ভেতরেই ফল পাওয়া যাবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। এক নিয়তে এ পানি পান করলে কোন নারী যে পুরষে পরিণত হবে না,- এমনটাও বলা যাবে না! সাতপরির দীঘির পানির আরো নানাবিধ গুণ জানা যায়। দীঘির পূর্ব পাড়ে রয়েছে হযরত শাহ কালা শাহ (রহ:) এর মাজার। হযরত কালা শাহের জীবদ্বশায় এ দীঘির পানি মিষ্টি ছিল বলেও এলাকাবাসীর ধারনা। দীঘি পশ্চিম দিকে গড়ে উঠেছে লোকবসতি, উত্তরে কৃষি জমি এবং দক্ষিণের পাড়টি দক্ষিণ দিকের জলাশয়কে পৃথক করে দেয়। এই পাড়টির দ্বারা দীঘিটি দুটো পুকুরে পরিণত হয় এবং সাতপারির দীঘি নামেও পরিচিত হয়ে উঠে। একত্রিত অবস্থায় এই দীঘিটি পূর্বেকার নাম কি ছিল তা জানা যায় নি? মোটর সড়কের পূর্ব দিকে হুমেরজান গ্রামে এই দীঘিটির অবস্থান। আর মোটর সড়কটি ক্রস করে পাশাপাশি পশ্চিমে দুই সতীনের দীঘি। এই দুই সতীন কারা, তা এখনো জানতে পারিনি? 
১৯৮১ সালে দেখা দক্ষিণ তিলকপুরের এই মাটির মসজিদটি এখন পাকাদেয়ালের মসজিদ। কিন্ত এখন পর্যন্ত তা মাটিয়া মসজিদ হিসেবেই পরিচিত। এখানে ইন্তাজ মিয়ার একটি চায়ের দোকান ছিল। ইন্তাজ মিয়া নিজের গরুর দুধ দিয়ে ভাল চা তৈরী করতো। তার তৈরী চায়ের ঘ্রাণটি এখনো আমার নাকে লেগে আছে। প্রতিদিন দু-চার-পাঁচ টাকার চা বিক্রি হতো। নিঃসন্তান সেই ইন্তাজ মিয়া এখন আর নেই। কিন্তু একটি চায়ের দোকানের পরিবর্তে সেখানে এখন ৪টি চায়ের দোকান রয়েছে। স্টেশনারী এবং ভূসিমালের রয়েছে আরো আটটি দোকান। এখানে সন্ধ্যার পর পর মানুষের বেশ জমায়েত হয়। ড্রাইভার জোনাব আলী জানান, প্রতিদিন ১০০০-১২০০ টাকার চা বিক্রি করতে পারেন তিনি। ভূসিমালের দোকানদার ফারুক মিয়া আমাদের জানান, তিনি প্রতিদিন ৩০০০-৩২০০ টাকার খরিদ বিকি করে থাকেন। ’৮১ সালের সন্ধ্যার পর একটি মানুষও এখানে খোঁজে পাওয়া যেতো না। সন্ধ্যার পূর্বেই ইন্তাজ মিয়ার দোকানটি বন্ধ হয়ে যেত। আদমপুর  থেকে আসার পথে বকুলী সিন্হার বাড়িতে উঠে চা-নাশতা করা হতো। প্রাণবন্ত সেই মেয়েটি এখন কেমন আছে জানি না। বকুলী এবং আমি একি সাথে লেখাপড়া করতোম। ভান্ডারীগাঁও হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ খুরশেদ উদ্দিন আহমদ আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার আনোয়ার হোসেন বাবু, কমলগঞ্জ মডেল স্কুলের সিনিয়র শিক কৃষ্ণ কুমার সিংহ, উষা রানী সিন্হা, বিয়ের পর ত্রিপুরা চলে যায়। প্রত্যেকেই তারা এখানকার বন্ধু ছিল আমার। এই আদমপুরে আমার অনেক স্মৃতি আছে, যা লিখলে বড় একটি উপন্যাস হয়ে যাবে। কিন্তু আমি কখনোই আত্মবিজ্ঞাপনে পারদর্শী নই। এত বেশি লিখব, কখনো তো ভাবিনি। শখ ছিল একটু-আধটু লিখব....bdupur@gmail.com



চলার পথে দেখা

॥ রৌদ্র দুপুর ॥

গেল হপ্তায় পাঠকদের আদালতে হাজিরা দিতে পারিনি। এটা সত্য। কিন্তু পথ চলাতো আর থেমে থাকেনি এটা ঈশ্বর পাড়ার ভদ্র পল্লীতেই হোক কিংবা বস্থবাদের কালজয়ী মানব দর্শনে হোক, তা চলছেই।  দুপুর বারোটা কিন্তু সকালে অনুভূতি এখনও কাটেনি। মিষ্টিরোদ যেন সকালের সকল বেনিফিটকে ধরে রাখছে। ভারীপোষাক গুলো যেমন উচ্চবিত্ত মানুষের শরীর জড়িয়ে রয়েছে তেমনি থাকিয়ে আছে শীতে হাঁপিয়ে উঠা দরিদ্র মানুষগুলো অসহায় চোখ। যাদের হাড়ে গিয়ে বাজে শীতের প্রচন্ড আঘাত। কমলগঞ্জ সংবাদ পরিবারের সদস্য প্রত্যয়ী যুবক মোঃ মনোয়ার হোসেন শামীম, সাংবাদিক মোঃ মিনহাজ নাসির, সৃষ্টি  সাংস্কৃতি সংঘের সভাপতি বিজ্ঞান মনস্ক যুবক এমরান আহমদ ও মুক্ত চেতনা সম্পন্ন যুবক মুরাদ আহমদ চৌধুরী মুন্না- আমরা পরস্পর সাথী হয়ে চলছি। মাথায়-গামছা বেঁধে চলছেন মসজিদের মোয়াজ্জিন। আমাদের থেকে মাত্র পাঁচ কদম আগে। ধলাই নদীর তীরে ইট-কাঠ দিয়ে একটি দালান তৈরি করছেন সুদক্ষ মিস্ত্রিরা । এর ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করছেন একজন ভদ্র ব্রাহ্মণ। কাল বৈশাখীর মত আমাদের পাশ কেঁটে চলে গেলেন ত্রিশুল হাতে এক সন্ন্যাসী; নির্বিঘেœ-আনন্দচিত্তে। শস্যহীন মাঠে মানুষের ভিড়কে ঠেলে কি যেন দেখছেন একজন দলিল লিখক। নদীর কূলে শিশুরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে আর পুরুষ এবং নারীরা মিলে দুপুরের গোসল সেরে নিচ্ছে। গ্রামের ছোঁয়ায় এইসব ঘটমান দৃশ্যপট প্রায়ই লক্ষ করা যায়। ঘুরে ঘুরে দেখা জীবনে প্রতিচ্ছবিগুলোর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ওঠে ‘চলার পথে দেখা’ প্রতিবেদনটিতে, প্রতি সাপ্তহেই। যেজন্যে সুহৃদ এবং পাঠকবৃন্দের কাছে নিজস্ব দূর্বলতা এবং দুঃখ প্রকাশ করছি। 
গত ২০ জানুয়ারী ’১৩ খ্রি. ছিল কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গলের মানুষের কাছে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। একটি আনন্দের দিন। চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ আমন্ত্রণমূলক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলাকে সাজানো হয়েছিল নতুনভাবে। নানা রঙের পোস্টার, ব্যানার, ফেষ্টুন ও তোরণ তৈরি করা হচ্ছিল। রেল মন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক উদ্বোধনী খেলায়  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এই টুর্নামেন্টে দ্বিতীয়বারের মতো কমলগঞ্জের মাটিতে হাজার হাজার মানুষের মিলন মেলা দৃশ্যমান হলো। খুব স্বাভাবিক কারনেই এই এলাকার মানুষ ক্রীড়ামোদী তেমনি ও অসাম্প্রদায়িক এবং সংস্কৃতসেবী। রাজনৈতিকভাবে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ এলাকার মানুষ পাক-আমল থেকে প্রগতিশীলতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ১৯৫৪ সালে মুসলিমলীগের প্রার্থী হাজী মো. উস্তারকে পরাজিত করে যুক্ত ফ্রন্ট প্রার্থী আলহাজ্ব কেরামত আলী এম.এল.এ নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রার্থী ব্যারিষ্টার আহমদুর রহমান খানকে পরাজিত করে কনভেনশন মুসলিমলীগের প্রার্থীর্  মোঃ মুহিবুর রহমান এম. এন. এ নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে বেগম সিরাজুনন্নেছা চৌধুরীকে পরাজিত করে কনভেনশন মুসলীগের প্রার্থী আলহাজ্ব কেরামত আলী  এম.এন. এ নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে জামাতে ইসলামের প্রার্থী আব্দুল জালাল চৌধুরী কে পরাজিত করে আওয়ামীলীগ প্রার্থী মোঃ ইলিয়াস এম.এন. এ নির্বাচিত হন। ১৯৭০  সালে মুসলীম লীগ প্রার্থী মোঃ মুহিবুর রহমানকে পরাজিত করে আওয়ামীলীগ প্রার্থী আলতাফুর রহমান চৌধূরী এম.এল.এ নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে স্বতন্ত্র সালে প্রার্থী রাজেন্দ্র বুনার্জিকে পরাজিত  করে আওয়ামীলীগ প্রার্থী আলতাফুর রহমান চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বি.এনপি প্রার্থী মোঃ মুহিবুর রহমানকে পরাজিত করে আওয়ামীলীগ প্রার্থী মোঃ ইলিয়াস এম.পি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোঃ মফিজ আলীকে পরাজিত করে আওয়ামীলীগের প্রার্থী মোঃ ইলিয়াস এম.পি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালের বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যাপক আব্দুর রউফকে পরাজিত করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আহাদ মিয়া এম,পি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি প্রার্থী অর্থমন্ত্রী মোঃ সাইফুর রহমানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ এম,পি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি প্রার্থী আলহাজ্ব শফিকুর রহমানকে পরাজিত করে আওয়াীলীগের প্রার্থী আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ এম.পি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী মহসিন মিয়া মধুকে পরাজিত করে আওয়ামীলীগ প্রার্থী আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে বিএনপি প্রার্থী আলহাজ্ব মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে স্বর্ণমুজিবকে পরাজিত করে আওয়ামীলীগ প্রার্থী আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ এম,পি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রচ্ছারী বিতর্কিত এবং ক্ষণস্থায়ী মেয়াদের ৬ষ্ঠতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ থেকে কোন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করেন নাই। দেশপ্রেমিক এই লোকটি নিঃসন্দেহ ঐতিহাসিক পৌরুষের দাবীদার। যুগ যুগ ধরে এই এলাকার লোকজন রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। প্রতিটি মানুষের মনের গভীরতায় দেশ প্রেম শব্দটি দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। যার পূজা কোনদিন সাঙ্গ হয় না।  
কমলগঞ্জ উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার এ.বি.এম সাজিদুল কবীর সাজিদের কোয়ার্টারে পৌঁছি সন্ধ্যার পর। তিনি অত্যান্ত চমৎকার মানুষ। রোগীর কাছে যেমন তিনি একজন ভাল ডাক্তার হিসেবে পরিচিত তেমনি এলাকার সকল মানুষের কাছে তিনি একজন ভাল বন্ধু হিসেবে পরিচিত। আমি তাঁকে জানি ভাল আড্ডাপ্রিয় একজন শিল্পী হিসেবে। তাঁর চলাফেরায় গুণী এলিটজনদের মতো কোন চাকচিক্য নেই। তাঁর চালচলন এতই সাদামাটা যে, সাধারন রোগীরা তাঁকে ডাক্তার হিসেবে ভাবতে আবাক লাগে। কিন্তু তাঁর চিকিৎসা সেবা অন্যান্য ডাক্তারদের চেয়ে অধিকতর ভালো। অনেক ডাক্তারদের মতো তিনি অর্থলিন্সু নন। সাধারণ রোগীদের সেবা দান করাই যাঁর  ধর্ম।সেদিন, আমাদেরকে পেয়ে তাঁর শিশুসুলভ মনটি মহা আনন্দিত হয়ে ওঠে। চা-চানাচুর খেতে খেতে পাঁচ মিশালী কয়েকটি গান শোনা হল, তাঁর কন্ঠে। তিনি একজন ভাল ডাক্তার এনিয়ে যেমন কোন   দ্বন্দ্ব নেই তেমনি একজন ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এসময় ব্রিটেনের কভেন্টি থেকে জনৈক কাউন্সিলর মুঠোফোনে আমাকে জানান দেন, কিভাবে বিগত নির্বাচনেকনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি হয়েছিল সেসব, গোপন তথ্যাদী। সহজ কথায় একমাত্র হীনমন্যতায় ওরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। চলে এলো আমার ড্রাইভার নৃপেন্দ্র। বেশ রাত হলে ফুঁসে উঠতে পারেন শাহানাজ ইসলাম চৌধুরী এই ভয়ে উঠে দাঁড়াই...bdupur@gmail.com